মোহাম্মদ শাহজাহান: চির তারুন্যে সমুজ্জল, সায়্যিদউল্লাহ খাঁন, যার মধ্যে ছিল রূপ, রস, সৌরভের হাতছানি। যিনি ছিলেন অন্ধকারে ও নির্ভীক। সদালাপী এই ব্যক্তিটির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় শিক্ষকতার সুবাদে। প্রথম পরিচয়েই আমার মনে হয়েছে লোকটি নির্লোভী। অর্থ বিত্ত ও খ্যাতি কোন কিছুর প্রতিই তার মোহ ছিল না। পর হিতে কিছু করতে পারলেই তিনি খুশি থাকতেন। তাইতো তার হাস্যবদনে কখনো বিষন্নতার ছাপ দেখিনি। শিক্ষকদের প্রতি ছিলেন সর্বদা নিবেদিত। শিক্ষকদের কোন সমস্যাকে তিনি নিজের সমস্যাই মনে করতেন। তিনি ছিলেন শিক্ষকদের প্রানস্পদন। নব্বইয়ের দশকে তিনি দ্বিধা-বিভক্ত শিক্ষক সংগঠন গুলোর সমন্বয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন তিতাস, মেঘনা, ও দাউদকান্দি উপজেলার শিক্ষকদের অবিসংবাদিত নেতা। ব্যক্তি জীবনে ছিলেন স্পস্টবাদী। সদা উদ্যমী এ মানুষটি অনুপ্রেরনা দিতেন শ্রেনীমত। তাঁর অনুপ্রেরনায় এম.এ পরীক্ষা দিয়ে ছিলাম। প্রিলিতে পাশ করেও অসুবিধার কারনে ফাইনাল না দেওয়ায় আমাকে তুলোধুনো করেছেন। ঠিক সেভাবেই যেভাবে একজন অভিভাবক তার সন্তানকে শাসন করে। তিনি আমাকে যেভাবে শাসিয়েছেন, তার সেই শাসনে এক অকৃত্রিম ভালভাসা আর ¯েœহ মিশ্রনের আভাষ উপলব্দি করেছি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গাজীপুর খাঁন হাই স্কুল এন্ড কলেজটির যেদিন কলেজ শাখার এমপিও ভুক্ত হলো তার কিছুদিন পর তাঁর বাসায় সাক্ষাত করতে গিয়ে ছিলাম ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। আমি সালাম দেওয়ার সাথে সাথেই বসতে বললেন। সেদিন তাঁর হাস্যবদনে এক চাপা অভিমানের ছাপ লক্ষ করলাম। আমাকে প্রশ্ন করলেন কেন মাষ্টাস্ কম্পিলিট করলাম না। তারপর বলতে লাগলেন আমি আশা করে ছিলাম আপনি মাষ্টাস্ কম্পিলিট করলে আপনাকে কলেজে নিয়ে আসবো। প্রতি উত্তরে আমি কিছু বলার পূর্বেই তিনি বললেন এখন আর সুযোগ নেই, এখন থেকে অর্নাস ছাড়া কলেজ শিক্ষক হওয়া যাবে না। কেমন দরদী আর কিরূপ হিতৈষী হলে আমার মত একজন নগন্য শিক্ষকের ও পদন্নোতির কথা চিন্তা করেছিলেন তিনি। এমন পরহিতৈষীকে কে ভাল না বাসে? তাই তো সায়্যিদ উল্লাহ খানের ভালবাসার জালে বন্দি হয়ে গেলাম। ভালবাসার আনন্দ নিয়েই বেচেঁ ছিলাম এতদিন। কিন্তু গত ১৮/১২/১২ইং কাল বৈশাখীর মত ছোবল হানল হৃদয়ে তার চিরবিদায়ের কথা শুনে। তার অকাল মৃত্যুর যাতনা সইতে না পেরে অজোরে কেঁদে ছিলাম রজনীর শেষভাগে, রাতের জোনাকীরা সে কান্না শুনেছিল কিনা জানি না। তবে অনুভব করেছি রাতের আকাশ কেদেঁছিল, আমি অজু করার জন্য ঘর থেকে রেরুলাম, মনে হল আকাশের কান্নাগুলো শিশিরের ফোটা হয়ে আমার মাথা ও শরীরে পড়ছে। বাড়ীর পাশের মসজিদের সুউচ্চ মিনার থেকে আজানের কন্ঠ ধ্বনি ভেসে আসছে- হাই আলাস্ সালাহ্….! আমি কক্ষে বিছানো জায়নামাজে গিয়ে বসলাম। রজনীর অন্ধকার বিদায় নিল। সকালে যথা নিয়মে গাজীপুর এসে জানলাম ২ (দুই) টায় জানাযা হবে মরহুমের। আমি গাজীপুর থেকে আমার কর্মস্থল জগতপুর সাধনা উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলাম। বিদ্যালয়ের সব শিক্ষকই তার মৃত্যুর সংবাদ যথা সময়ে পেয়েছিল। আমার প্রধান শিক্ষক হযরত আলী ভূইয়া ও পূর্ব থেকেই জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য গাজীপুর চলে এসেছেন। আমি কাল বিলম্ব না করে গাজীপুর কলেজ মাঠে চলে আসলাম।
গাজীপুর কলেজ মাঠ যেন এক বিশাল জন সমুদ্র। মরহুমকে ঘিরে তার হিতাকাংকীর ভিরের মধ্যে আমি আমার বন্ধুর শেষ মুখখানা দেখতে গেলাম। ভির ঠেলে যাবার পথে দু’জন শিক্ষককে কোলাকুলি করে কাদঁতে দেখলাম, আমাকে দেখে যেন তাদের কান্নার ঢেউ আরও দ্বিগুন হয়ে গেল। আমি তাদের কান্নার সাথে সামিল হইনি। কারণ আমি তো তাদের মত নরম হৃদয়ের লোক নই। আমি আমার বন্ধুর শেষ মুখখানা দেখলাম, পাশের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম স্যারের কবর হবে কোন খানে? বললেন পীড় শাহবাজের মাজারের পূর্ব পাশে। আমি নীরবে দাড়িয়ে রইলাম। মনে হল-
এক সাদা চাদরের ভিতর কাফন হল তার
সমস্ত কলেজ মাঠ যেন সচ্ছ হ্রদ, মানুষের ঢল
সৌরভ যেন দেখছে বেদনার নীল আকাশ
এক অজানা বেদনা কোলাহলের ভিরে
বরফ গলা পানির মত ফোটায় কোঠায় ঝরে
আমার অশ্রু দু’টি গাল বেয়ে।
আমি বিষন্ন কান্নায় চোখে নির্বাক।
মনে হয় একটি অমাবস্যার চাদ যেন
শায়িত পীড় শাহবাজের পাশে।
মরহুমকে ঘিরে অনেকেই স্মৃতি চারন করলেন। আমি স্মৃতি চারনের কোন সুযোগ পাইনি। কারণ যারা স্মৃতি চারন করেছেন তাদের তুলনায় আমি খুবই নগন্য। তাছারা সময় ও ছিল খুব কম। কারন যথা সময়ে জানাযাই সকলের কাম্য।
জানাযা শেষ হওয়ার পর আমি একটি মিছিল দেখলাম।
এ মিছিল, মিছিল নয় এটি আমার কবিতা। ১৯৯৬ সালে সায়্যিদ উল্লাহ খানের অনুপ্রেরনায় আমার ‘‘মিছিল’’ নামক কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই কাব্য গ্রন্থেরই একটি কবিতার নাম ‘মিছিল নয়’।
আমি একটি মিছিল দেখেছি
এ মিছিলের নাম আমি জানি না।
কারণ, আমার বন্ধুকে সাদা ধুতি মুড়িয়ে
চার পায়ায় সোজা শুইয়ে
চারজন কাধে লয়ে
নীরবে নীরবে চলে সমাধির স্থল।
পিছে চলে পাড়াপড়শী হিতাকাংখীর দল।
সারিবদ্ধ দল নিঃশব্দে চলে।
এ মিছিল ‘মিছিল নয়’
লাশ কাধে বলে।
যে সায়্যিদ উল্লাহ খানের চির বিদায়ে আমার হৃদয় ক্ষত বিক্ষত। সে সায়্যিদ উল্লাহ খানের আবার আবির্ভাব ঘটুক। আমি জেগে উঠি, ভূলে যাই বন্ধু বিরহের যাতনা। জানি না এ জীবনে পাব কিনা তারমত একজন অভিভাবক, একজন অকৃত্রিম চিরতরুন বন্ধু। যে আমাকে ভালবাসবে তারমত। ঠিক তার মতই নির্লোভী, পরহিতৈষী, সদালাপী। আমি সে প্রত্যাশায় রইলাম, এখনও মানবতার ‘মুক্তির মিছিলে’।
কারণ, এ দেশ, এ মাটি, এ প্রান
আমরা এ দেশেরই সন্তান।
মোহাম্মদ শাহজাহান, শিক্ষক ও সাংবাদিক
মোবাইল ঃ ০১৮২৩৪৬১৪৯৫